নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসন-৭৭ কুষ্টিয়া-০৩ (সদর) আসনে ভোট কারচুপি, ভোট পরবর্তী সহিংসতার প্রতিবাদে, পুনরায় নির্বাচনের দাবীতে ডিসি কোর্টের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। মানববন্ধন শেষে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক এবং জেলা রিটার্নিং অফিসার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ার তনুর সমর্থকরা।
বুধবার সকালে উক্ত কর্মসূচি পালন করা হয়। এসময় মানববন্ধন থেকে ভোট চোর ভোট চোর শ্লোগান দেয় কর্মীসমর্থকরা।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার আলী, পারভেজ আনোয়ার তনুর সমর্থক যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মাহাতাবুল হক জয়।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন পারভেজ আনোয়ার তনুর কয়েকজন সমর্থক। ডিসি কোর্টের সামনে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে কয়েক হাজার কর্মী সমর্থক এই মানববন্ধনে অংশ নেন। যদিও ব্যানারে আয়োজনে উল্লেখ ছিল কুষ্টিয়া ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ।
আনোয়ার আলী তার বক্তব্যে বলেন, ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানান। নইলে পরবর্তীতে আরো বড় কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি।
স্মারকলিপি হুবহু তুলে ধরা হলো:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসন-৭৭ কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে আমি (পারভেজ আনোয়ার তনু) নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আপনি বলেছিলেন ভোট অত্যন্ত সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ হবে। প্রতিটি কেন্দ্র নিরাপদ থাকবে এবং কোন বহিরাগত কেন্দ্রে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু ভোটের আগের রাতে ও ভোটের দিন কেন্দ্রে পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ উল্টো।
ভোটের আগের রাতে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নৌকার প্রার্থীর ক্যাডাররা স্বদলবলে প্রতিটি ইউনিয়নে ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে মহড়া দিতে এবং আমার পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেয়া শুরু হয়। ওই রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আমার পোলিং এজেন্টদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হয়। ভোটের আগের রাতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ‘মানব’ চাকি ও তার লোকজন আমার সমর্থকদের ঘরে ঘরে যেয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয় যাতে তারা ঈগলের এজেন্ট না হয় বা ভোট দিতে না যায়। ভোটের আগের রাতে নেতা কর্মীদের মাধ্যমে যে কোন মূল্যে ভোট কেন্দ্র দখল করে আমার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন বলে আমরা জানতে পারি। আমি তৎক্ষনাত আপনাকে বিষয়টি অবগত করি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব আচরণ বিধির সুস্পষ্ট লংঘন সত্ত্বেও কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। দলীয় পদধারী ও প্রার্থীর আস্থাভাজন লোকজনকে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ প্রদান করা হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে অনেক শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অস্থায়ী ও নন এমপিও দু’জন প্রভাষক জনাব সুজন কুমার বিশ্বাস ও প্রতাপ কুমার বিশ্বাসকে অসৎ উদ্দেশ্যে প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদেরকে বিভিন্ন সময় নৌকার প্রচারণায় অংশ দিতে দেখা যায় এবং দলীয় পদধারী একাধিক শিক্ষককে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। আমি লিখিত অভিযোগ করলেও তাদের বাদ দেওয়া হয়নি।
আপনারা বলেছিলেন ভোটের দিন সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে ভোট কেন্দ্রে যেয়ে আমার পোলিং এজেন্টদের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে রিপোর্ট করতে। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে নৌকার কর্মীরা আমার এজেন্টকে কেন্দ্রের ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। কিছু কেন্দ্রে এজেন্টরা ঢুকলেও ভোট গ্রহণ শুরুর পর পরই তাদেরকে পিটিয়ে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টার মধ্যে জানতে পারলাম ৫২ টি কেন্দ্র থেকে আমার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। তখন আমি সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারদের ফোন করে তাদের সাহায্যে চাইতে থাকি। কিন্তু আমি তাদের কোন সহযোগিতা পায়নি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিভিন্ন অনিয়মের খবর আসতে শুরু করে। বেলা ১১টার মধ্যে আমার প্রায় ৭০টি কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেয়া হয়।
শহরের কুওয়াতুল ইসলাম আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রের মহিলা পোলিং এজেন্টটের কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র ও নিয়োগপত্র কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলে এবং তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়। হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিলন মণ্ডল পোলিং এজেন্টদের বের করে দেন। আব্দালপুর ইউনিয়নের হাসানবাগ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোলিং এজেন্টকে মেরে রক্তাত্ব করা হয়, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এছাড়াও বিষ্ণুদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জিয়ারখী, ঝাউদিয়া, বটতৈল, আলামপুর, হরিনারায়নপুর, গোস্বামী দুর্গাপুর, মনোহরদিয়া, পাটিকাবাড়ি ও কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন ও পৌরসভা অন্তর্গত শতাধিক কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটতে থাকে।
এরপর বাঁকি কেন্দ্র থেকে খবর আসতে থাকে পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেয়া হচ্ছে ও বের হয়ে যেতে বলা হচ্ছে। দুপুর ১২টার দিকে সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ ২১ কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার বরাবর ভোট স্থগিত করার লিখিত আবেদন পাঠায়। মাত্র ২টি কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার আবেদন গ্রহণ করেন, কিন্তু বাকিরা কেউ আবেদন গ্রহণ করেন নাই। মিনিটে মিনিটে আরো অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের খবর আসতে থাকে। দুপুর একটার মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্র বাদে অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে আমার পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট কেন্দ্র দখলে নেয় আমার প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী মাহাবুবউল আলম হানিফের কর্মী-সমর্থকরা। দুপুর দেড়টা থেকে খবর আসতে থাকে আমার পোলিং এজেন্ট শুন্য করে প্রশাসনের সহায়তায় নৌকায় সিল মারা হচ্ছে। আমি আপনার কাছে মোবাইলে যোগাযোগ করে অভিযোগ করেও কোনো সহায়তা পায়নি। কোন উপায়ন্ত না পেয়ে দুপুর দেড়টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে মিডিয়ার মাধ্যমে আবেদন জানাই কুষ্টিয়া-৩ আসনের ভোট স্থগিত করার। আমি সাথে সাথে আপনার বরাবর অভিযোগ উল্লেখ করে সদর আসনের ভোট স্থগিতের জন্য লোক মারফত লিখিত আবেদনপত্র প্রেরণ করি। কিন্তু আপনার কার্যালয় থেকে আমাদের আবেদন গ্রহণ করে নাই। আপনি কার্যালয়ে ছিলেন না বিধায় আমরা আবেদনপত্রটি আপনার অবগতির জন্য রেখে আসি। উল্লেখ্য বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমি নিজে ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানতে পারি দুপুর একটা পর্যন্ত অধিকাংশ কেন্দ্রে ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পোল হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রে কোন ভোটার না থাকলেও মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘন্টায় অস্বাভাবিকভাবে আরো ৩০ শতাংশ ভোট পোল দেখানো হয়। যা কোনভাবেই বিশ্বাস যোগ্য না।
মহোদয়, ভোটে কারচুপি করে জয়লাভের পর ওই রাত থেকেই আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর শুরু হয়েছে হামলা ও বাড়ি ঘর ভাংচুর লুটপাট। ওই রাতেই পৌর ২০ নং ওয়ার্ডের কুমারগাড়া এলাকায় আমার সমর্থক রজব আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাঁর সারাশরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে নৌকার সমর্থক স্থানীয় কাউন্সিলর এজাজ আহমেদের ক্যাডাররা। প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন ক্যাডার ধারালো অস্ত্র নিয়ে রজব আলীর ওপর হামলা করে। এসময় সন্ত্রাসীরা তাঁর সারাশরীর কোপাতে থাকে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রজব আলীর হতের দশটি আঙ্গুল, বুক, পিঠ, দুই পা’সহ সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তাঁকে বাঁচাতে ভাতিজা বেলাল হোসেন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা তার মাথায়ও কোপ দেয়। এতে কেবলালের মাথায় ছয়টি সেলাই দেয়া লেগেছে। ভোটের পরের দিন সোমবার সকালে সদর উপজেলার গোস্বামী দূর্গাপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান দবির উদ্দিনের নেতৃত্বে একাধিক বাড়িতে হামলা ভাংচুর লুটপাট ও কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। প্রায় ২০/২৫ জন ক্যাডার স্থানীয় খালেক, খেদ আলী, বানাত মালিথা ও সেন্টুর বাড়িতে এ হামলা চালায়। মঙ্গলবার সকালে মনোহারদিয়া ইউনিয়নে আমার নির্বাচনী এজেন্ট মান্নান তালুকদারকে হাতুড়ি পেটা করা হয়েছে। অধিকাংশ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার আমার কর্মী-সমর্থকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হানিফের ক্যাডাররা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এলাকায় পাওয়া গেলেই তাদের ব্যবস্থা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
মহোদয়, আমি আপনার আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকার চেষ্টা করেছি। বিনিময়ে আজ আমার কর্মী-সমর্থকদের জীবন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। ‘সকল কেন্দ্র নিরাপদ থাকবে’ আপনার এমন আশ্বাসে আমাদের পোলিং এজেন্ট ও সেন্টারের-অর্ডিনেটরদের বলেছিলাম যে তারা নিরাপদ থাকবে। আপনার কথার কারনে আমার অনেক ভাই-বোন যারা আমার পোলিং এজেন্ট অথবা সমর্থক হিসাবে কাজ করতে গিয়েছিল আজ তাদের অনেকেই হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর শয্যায়। অথবা কেউ বাড়ি ঘর হারিয়েছে। অনেকেই পরিবার ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি এধরণের ভোট ডাকাতি ও প্রহসনের নির্বাচন আশা করিনি। আমি অবিলম্বে সংসদীয় আসন-৭৭ কুষ্টিয়া-০৩ আসনে পুনরায় ভোট গ্রহণের জোর দাবী জানাচ্ছি।