বাংলার মানুষ আজ হাঁপিয়ে উঠেছে ‘চেতনা ব্যবসায়ীদের’ ভণ্ডামিতে। ‘৭১-এর চেতনা’—এক সময়ে যে শব্দগুচ্ছটি ছিল মুক্তির প্রতীক, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রেরণা, আজ তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতার দম্ভ, দমন আর প্রতারণার হাতিয়ারে। যাঁরা এক সময় জাতির মুক্তির প্রতীক হিসেবে চেতনার কথা বলতেন, এখন তাঁরাই সেই চেতনার নামে একচ্ছত্র শাসনের বৈধতা দাবি করছেন। চেতনার নামে চালানো হচ্ছে ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন, সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন অপব্যবহার।গত দেড় দশক ধরে আমরা দেখেছি—‘৭১-এর চেতনা’কে পুঁজি করে কীভাবে শেখ হাসিনার সরকার দেশে একটি একদলীয় প্রবণতা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এমনকি গণমাধ্যমকেও হাতের মুঠোয় নিয়ে এক নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করলেই গায়ে ‘রাজাকার’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, কিংবা ‘চেতনা বিরোধী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রকৃত চেতনা তো ছিল গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা।
২০২৪ সালে এসে আমরা দেখছি এক নতুন ধরনের ‘চেতনা ব্যবসায়ী’ শ্রেণির উত্থান। তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ ও অবস্থানকে “চেতনার ধারক ও বাহক” হিসেবে জাহির করছেন, এমনকি নিজেদের সরকারপ্রধান বা ‘জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি’ মনে করছেন—যদিও তাঁরা কোনো গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত নন। তাদের ভাষায়, সুরে, আচরণে এবং প্রয়োজনে দমনমূলক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের আত্মম্ভরিতা ও কর্তৃত্বপরায়ণতার ছাপ স্পষ্ট। এ যেন পুরোনো শাসকের ছায়ায় নতুন শাসকের অনুশীলন।এই নতুন চেতনাবাজ গোষ্ঠীও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে। যে প্রশাসন কখনো বলেছিল—“আমরা জনগণের দিকে মারণাস্ত্র তাক করব না”—তারা আজ গোপালগঞ্জে গুলি চালিয়ে চারজন মানুষকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি একটি চেতনাধারী শক্তির মুখোশ খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা।একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে জনগণের বিশ্বাস, আস্থা ও অংশগ্রহণে। আর এই আস্থা আসে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি থেকে। কিন্তু যখন রাষ্ট্র নিজেই জনস্বার্থবিরোধী ও কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ে, তখন সেই আস্থা ভেঙে যায়। আর তখনই জনগণ ঘুরে দাঁড়ায়।আজ বাংলার মানুষ সেই ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বারপ্রান্তে। ‘চেতনা’র নামে ক্ষমতা ভোগের যুগ শেষ করতে তারা প্রস্তুত। তারা বলছে—এই চেতনার ব্যবসা আর চলবে না। স্বাধীনতা কারও একক সম্পত্তি নয়। সংগ্রাম কোনো রাজনৈতিক দলের বা ব্যক্তির একচেটিয়া সম্পদ নয়। চেতনার নামে আর কেউ স্বৈরাচার চালাতে পারবে না।
আজ আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পুরনো ও নতুন—দু’ধরনের চেতনা ব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দেওয়া প্রয়োজন। দরকার নতুন প্রজন্মকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ শেখানো—যেখানে থাকবে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল আস্থা।চেতনার ব্যবসা নয়, চেতনার চর্চা হোক। নিপীড়ন নয়, প্রতিরোধের চেতনা জাগুক। আজ দরকার ৭১-এর চেতনার প্রকৃত ব্যাখ্যা—যা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মুক্ত কণ্ঠের স্বাধীনতার জন্য, আর একটি প্রজন্মকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচার পথ দেখানোর জন্য।এই চেতনার পুনর্জাগরণেই রক্ষা পাবে বাংলাদেশ।
শাহারিয়া ইমন রুবেল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সপ্তাহিক পথিকৃৎ।