দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে দেশের বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) বিরুদ্ধে বারবার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের থানা থেকে প্রত্যাহারও করা হচ্ছে; কিন্তু তাতেও এসব বন্ধ হচ্ছে না। তাই ৭ জানুয়ারি ভোটের আগে থানার ওসিসহ মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শকদের বিষয়ে কঠোর নজরদারি শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে নানা কৌশলে ভোট চাওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থকদের হুমকি দেওয়া, মিথ্যা মামলায় হয়রানি, আটক এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করার মতো অভিযোগ উঠেছে ওসিদের বিরুদ্ধে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে জেলার পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নিয়মিত এ ধরনের অভিযোগ আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে ওসিদের কার্যক্রম নজরদারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন কমিশনার এবং জেলা পুলিশ সুপারদের সতর্ক থাকতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিভিন্ন রেঞ্জে সফর করে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকে পুলিশকে শতভাগ পেশাদারিত্ব, সততা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতি স্বাভাবিক রাখতে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতেও বলছেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সব সময়েই পুলিশকে শতভাগ পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক দায়িত্ব পালনে যাতে পুলিশের পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে না পড়ে–সে বার্তা আগেই বিভিন্ন ইউনিটে দেওয়া হয়েছে। এরপরও কিছু কিছু জেলা থেকে ওসিদের প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এমনকি একজন এসপিকেও বদলি করতে হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষতা বা দায়িত্ব পালন নিয়ে যাতে আর অভিযোগ না ওঠে সেজন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকেই নজরদারি করা হচ্ছে এখন।
জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর একই থানায় ৬ মাসের বেশি দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন ৩৩৮ জন ওসিকে বদলি করে নির্বাচন কমিশন। পরবর্তী সময়ে আরও এক ডজনের বেশি ওসিসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি ও প্রত্যাহার করে কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভয়ভীতি ও স্বজনদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার ওসি মো. আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে। তাকে দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আইজিপি কাছে গত ১৭ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগ করেন ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কাবির মিয়া। রংপুর-২ আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মণ্ডল বদরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও এমপি আহসানুল হক চৌধুরীকে পুলিশ প্রটোকল প্রদানের অভিযোগ তোলেন। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ভোটার ও সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ লিখিতভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে দিয়েছেন জাপা প্রার্থী।
নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে দুই ইউপি চেয়ারম্যানকে হুমকির অভিযোগ উঠেছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ওসির বিরুদ্ধে। হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ বি এম আনিছুজ্জামান আনিছ। গত ২০ ডিসেম্বর নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনসহ সমর্থকদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে এই অভিযোগ করা হয়।
এদিকে পক্ষপাত এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার ওসি ঠাকুর দাস, হরিণাকুণ্ডু থানার ওসি মাহবুবুর রহমান এবং মাদারীপুরের কালকিনি থানার ওসি নাজমুল হাসানকে সরানো হয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার ওসি, সদরপুর থানার ওসি ও ভাঙ্গার ওসিকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ওই জেলার পুলিশ সুপারকে বদলি করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের সব পর্যায়ের সদস্যের প্রতি নির্দেশনা হলো, পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা। এই নির্দেশনা বহাল আছে এবং থাকবে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে একই থানায় আছেন তাদের বদলি করেছে। এরপর কাউকে কাউকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে আরও বেশি অভিযোগ থাকলে পরবর্তীতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ সদস্যরা নিরপেক্ষ আচরণ করছে কি না, তা সদর দপ্তর থেকে নজরদারি করা হচ্ছে।
কালবেলা