বাংলাদেশকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার ‘নিট রিজার্ভ’ ১ হাজার ৭৭৮ কোটি (১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের এখন নিট রিজার্ভ আছে দেড় হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নতুন এই লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছে। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত আইএমএফের একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ঋণদাতা সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্যমাত্রা কার্যত কমিয়ে ধরেছে। কারণ, বছরের শুরুতে ডিসেম্বরের জন্য লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। নতুন লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে ৯০০ কোটি ডলারের মতো কম।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল বাংলাদেশ সময় সকাল আটটায় আইএমএফের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থাটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের ওপর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা রয়েছে। এতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্য জানানো হয়। এর আগে সংস্থাটি গত জুনের জন্য একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল। তা বাংলাদেশ পূরণ করতে পারেনি।
অবশ্য এতে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৯ কোটি ডলার অনুমোদন করে সংস্থাটি।
রিজার্ভের নতুন লক্ষ্য পূরণের জন্য বাংলাদেশ সময় পাবে ১৫ দিনের মতো। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির কারণে মোট রিজার্ভ বাড়লেও নিট রিজার্ভ বাড়বে না; বরং দায় বেড়ে যাবে।’ তিনি বলেন, নিট রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আর ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন ডলার বাড়তি সংগ্রহ করতে হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে কিছু ডলার আসবে। আর কিছু ডলার কিনতে হবে। তারপরও এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।
বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ নিয়েছে, তার বেশ কিছু শর্তের মধ্যে একটি হলো বৈদেশিক মুদ্রার নির্দিষ্ট মজুত থাকা। গত জুনের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময় নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের মতো। গত অক্টোবরে নিট রিজার্ভ আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ডলারে। তখন মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি।
আইএমএফের সদস্যদেশগুলো ২০১২ সাল থেকে ব্যালান্স অব পেমেন্টস ও ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। বাংলাদেশ তা করছিল না। আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ গণনায় গত জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিপিএম ৬ অনুযায়ী হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেওয়া কিছু অর্থও দায় হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। আরও কিছু খাতের অর্থ নিট রিজার্ভের হিসাবে ধরা যায় না। ফলে এটি দাঁড়ায় ব্যবহারযোগ্য রির্জার্ভে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
ঘাটতি কমছে
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের চলতি হিসাবের যে ঘাটতি ছিল, তা কমে আসছে। আমদানি সংকোচন করার নীতি এবং পাশাপাশি রপ্তানি ভালো হওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল যে ঘাটতি ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।
আইএমএফ বলেছে, প্রথমে কোভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর অনেকেই এখনো আর্থিক কঠোরতার মধ্যে রয়েছে। ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারেও বড় ধরনের উত্থান-পতন হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি কঠোর করেছে, বিনিময়হারকে আরও নমনীয় করেছে, প্রচলিত বিনিময় হারগুলোকে একীভূত করেছে এবং আর্থিক নীতিগুলোকে যতটা সম্ভব কঠোর করেছে।
অর্থনীতির স্বার্থে মোটা দাগে তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশকে জোর দিতে হবে জানিয়েছে আইএমএফ। সেগুলো হলো কর রাজস্ব বৃদ্ধি; কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমানো ও মূল্যস্ফীতি কমানোসহ মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণ করা এবং ব্যাংক খাতে তদারকি বৃদ্ধিসহ আর্থিক খাতে সংস্কার আনা।
আইএমএফের রাহুল আনন্দ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা আছে। দেশটির উচিত হবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দেওয়া। রাজস্ব আদায় ভালো হলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে রাহুল আনন্দ বলেন, এ ধরনের বিষয় নিয়ে আইএমএফ কোনো কথা বলে না।
বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ‘সন্তোষজনক
আইএমএফ বলেছে, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সন্তোষজনকই এবং আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পূরণ করেছে। তবে ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে গভীর করতে হবে।
আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলেও বাজেট ঘাটতি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধসংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি। তবে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনসহ কাঠামোগত সংস্কারের বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করেছে।
প্রথম আলো