Pathikrit Most Popular Online NewsPaper

    ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ:

    গেল ৭ই জানুয়ারি বিএনপিসহ বেশ কিছু দলের দীর্ঘদিনের দাবি ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন’ উপেক্ষা করে সংবিধান রক্ষার মোড়কে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের আগামীর সংসদ হবে বিরোধী দলবিহীন বাকশাল মডেলের সংসদ, সংসদীয় গণতন্ত্রের সংসদ নয়।

    সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ কখনও বিরোধী দলবিহীন হয় না। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যে বাকশাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ছিল সকল দলকে একদলে রূপান্তরিত করত: সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রবর্তন। আর এবারকার বিষয়টি হলো, সংসদীয় ব্যবস্থায় বাকশাল বা একদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা, যেখানে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই যা মূলত: সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিরোধী। এটি কিভাবে হতে পারে, যদিও বিষয়টি সবার কাছে বোধগম্য, তারপরেও কিছুটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। এই মৌলিক বিষয়টি আলোচনার পূর্বে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা এবং কারা বিরোধী দল হওয়ার যোগ্য এ বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করব।

    সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত কোন রাষ্ট্রের সংসদ বা আইন পরিষদ গঠনে ন্যূনতম দুটি দলের উপস্থিতি অপরিহার্য। মূলত: এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় বহু দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। নির্বাচনে বিজয়ী মেজোরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে, আর মাইনোরটি দল সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে থাকে। জোটভিত্তিক নির্বাচন হলে বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে কোন জোটে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার অংশীদারও হতে পারে অথবা বিরোধী দলের অবস্থানও গ্রহণ করতে পারে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট বিরোধী দল সংসদের হৃদপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতি কখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে না।

    মাধ্যমেই ইতোমধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভের পর নতুন দল গঠন করত: বিরোধী দল হওয়ার সুযোগও নেই। বাস্তবতা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা কখনই সংসদে নিজস্ব অবস্থানে থেকে বিরোধী দলের মত ভূমিকা পালনের অভিনয় করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কেননা, তারা তাদের দল তথা আওয়ামী লীগের নেত্রীর বদন্যতায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে সক্ষম হয়েছে।

    এখন ধরা যাক জাতীয় পার্টির কথা। তাদের নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা সর্বমোট ১১, এ সংখ্যা দিয়ে বিরোধী দল গঠন বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়মের বাইরে। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বিরোধী দল হিসেবে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি পেতে হলে অত্র দলের আসন সংখ্যা ন্যূনতম ২৫ হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্ধারিত হয়। পূর্ববর্তী নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয় পার্টির সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচিত সদস্য ছিল তাই তারা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। যদিও তাদের ভূমিকা ছিল নামে মাত্র। সমালোচকের দৃষ্টিতে, গণতান্ত্রিক ইতিহাসে তারাই একমাত্র বিরোধী দল যারা ভূমিষ্ঠ হয়েছে সরকারী দল আওয়ামী লীগের উদর হতে। এতসব বিবেচনায় বাংলাদেশের এবারকার সংসদ হতে চলেছে বিরোধী দলবিহীন। অতএব এ আশঙ্কা করলে ভুল হবে না যে, আগামীর সংসদ একদলীয় সংসদ হতে যাচ্ছে, এর মাধ্যমেই পুরনো বাকশালী ব্যবস্থা সংবিধানের আবরণে আবারও প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।

    লেখক – অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    Spread the love