লাইসেন্স নবায়ন বিহীন হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যু
কুষ্টিয়া অফিস ॥
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই চলছে জেলার ৪৬ হাসপাতাল। লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই দেদারসে চলা এসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তারপরও চোখ বন্ধ জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের। অভিযোগ থাকলেও সচরাচর তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়ার চিত্র পরিলক্ষিত হয় না।
সবশেষ গত ১০ ডিসেম্বর নবায়নবিহীন চলা জেলা শহরের ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নিহত ঐ প্রসূতির নাম নার্গিস (২৮)। তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামের তারিফ মিস্ত্রির মেয়ে।
মৃত নার্গিসের স্বজনদের আহাজারি
নিহতের স্বজনরা জানান, গত শনিবার নার্গিসের পেটে ব্যথা অনুভব হলে তাকে ডা: উম্মে আজিজা ওয়াহিদ নন্দিনীর তত্ত্বাবধানে এখানে ভর্তি করা হয়। রবিবার ডাক্তার দেখার পর রোগীকে সনো করতে বলে। ঐ দিনই রোগীর সনো করার পর ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলে কিডনীতে পাথর আছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কর্তব্যরত নার্স রোগীর শরীরে বেশ কয়েক ধরনের ইনজেকশন পুশ করেন। পুশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী নিস্তেজ হতে থাকে। বিষয়টি নার্সরা মুঠোফোনে ডা: নন্দিনীকে অবহিত করার পর নন্দিনী হাসপাতালে ছুটে আসেন এবং রোগীকে সাথে করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে যাওয়ার পর রোগী দেখে ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সামনের ফটকের শাটার বন্ধ। বাধ্য হয়ে পিছনের ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা হয়। দেখা যায়, আগে থেকেই অপারেশন থিয়েটারে সিজারের জন্য একটি রোগী রয়েছে। কিন্তু সেখানে নেই কোন এ্যানেস্থেসিয়া ডাক্তার। কিছুক্ষণ পর সেই রোগীকে তার স্বজনরা নিয়ে চলে যান। সেসময় কথা হয় ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালের ওটি ইনচার্জ ফারজানা ববির সাথে। তিনি বলেন, নার্গিস ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার ফলস পেইন উঠেছিল। সেই কারণে এখানে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে সনো করে দেখা যায় তার কিডনিতে পাথর। সেই চিকিৎসা চলছিল। আপনাদের এখানে আবাসিক মেডিকেল অফিসার কে আছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট রকিবুর রহমান আরএমও হিসেবে আছেন। এখানে কোন ডাক্তার সার্বক্ষণিক বসেন না বলেও স্বীকার করেন তিনি। এই হাসপাতালটি ২০ বেডের। যখন যে ডাক্তারের রোগী আসে তখন সেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রোগী থাকে। হাসপাতালের মালিকের নাম ইয়ারুল ইসলাম বলেও জানান তিনি। তবে সেসময় বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতালের কোন পরিচালককে পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের কথিত আবাসিক মেডিকেল অফিসার রকিবুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট। ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালে মাঝেমধ্যে গিয়ে হিসাব নিকাশ করে দিয়ে আসি। আবাসিক মেডিকেল অফিসার হতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার হতে হয়। আমি সেখানে কিভাবে আরএমও হবো। যে বলেছেন তিনি মিথ্যা বলেছেন। আর ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালে কোন সার্বক্ষণিক ডাক্তার নেই।
বিষয়টি নিয়ে ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালের মালিক ইয়ারুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নার্গিস নামের ঐ রোগী ডাঃ নন্দিনীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। মানুষ অসুস্থ হলে হাসপাতালে আসে, মারা গেলে সেটাতো আমাদের হাতের কিছু না। আমার এখানে যে ডাক্তার রোগী দেখেন সেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রোগী থাকে। এখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার কেউ থাকেন না বলেও স্বীকার করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখানে রকিবুর রহমান অফিসিয়াল ফাইল দেখেন। তিনি আবাসিক মেডিকেল অফিসার না। এই বলে তিনি বিস্তারিত আলাপের জন্য প্রতিবেদককে বিকালে তার প্রতিষ্ঠানে দেখা করার কথা বলেন।
এই ব্যাপারে ডা: উম্মে আজিজা ওয়াহিদ নন্দিনী জানান, ঐ রোগীর ডায়াবেটিকস সহ নানা জটিলতা ছিল। রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
অন্যদিকে, ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালের আইনী বৈধতা সহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে। এই হাসপাতালটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স নবায়ন করেননি। তাছাড়া গত ২ বছর হাসপাতালটির ফায়ার লাইসেন্সও নবায়ন করা হয়নি। সেই সাথে ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতালের নারকোটিকসের (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত) লাইসেন্স এখনো হয়নি এবং শ্রম অধিদপ্তরের লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন করা হয়েছে কিনা তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১০ বেডের হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে কমপক্ষে ৩ জন এমবিবিএস চিকিৎসক, ৬ জন নার্স ও ২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার শর্ত আছে। এছাড়াও প্রতিটি শয্যার জন্য থাকতে হবে ৮০ বর্গফুট জায়গা, অস্ত্রোপচারের জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রোপচার কক্ষ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং নারকোটিকসের লাইসেন্স থাকতে হবে। উপরে উল্লেখিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আরো থাকতে হবে- ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) ও বিআইএন (বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর), ফায়ার লাইসেন্স এবং অধিদফতরের ছাড়পত্র। শয্যা বেশি হলে আনুপাতিক হারে জনবলও থাকতে হবে। এরপর আবেদনের ভিত্তিতে অধিদফতরের টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে লাইসেন্স দেবে।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৯৪ টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে ৫টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত, ১২ টি ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত, ৭টি ২০২০-২১ অর্থ বছর পর্যন্ত ও ২২টি ২০২১-২২ অর্থ বছর পর্যন্ত তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। চলতি অর্থ বছরে (২০২২-২০২৩) লাইসেন্স নবায়ন করেছেন ৪৮টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অর্থ বছর অনুযায়ী লাইসেন্স নবায়ন করা প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হলো- সেবা প্রাইভেট ক্লিনিক ২০১৯-২০ পর্যন্ত, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ইনসাফ ডায়গনস্টিক এন্ড মেডিক্যাল সার্ভিস ২০২১-২২ পর্যন্ত, দি বেঙ্গল প্যাথলজিস্ট ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ইবনে সিনা প্রাইভেট হাসপাতাল ২০২১-২২ পর্যন্ত, রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিক ২০১৯-২০ পর্যন্ত, সূর্যের হাঁসি নেটওয়ার্ক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ইমদাদ সেতারা খান কিডনি সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, ডক্টরস ল্যাব প্রাইভেট ক্লিনিক ২০২০-২১ পর্যন্ত, সেভ ডায়াগনস্টিক এন্ড সার্ভিসেস ২০২১-২২ পর্যন্ত, কুষ্টিয়া সার্জিক্যাল ক্লিনিক ২০১৮-১৯ পর্যন্ত, বাহার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, মুন মেডিকেল সার্ভিসেস ২০১৯-২০ পর্যন্ত, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ঝাউদিয়া ক্লিনিক ২০২০-২১ পর্যন্ত, গ্রামীণ কল্যাণ ঝাউদিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০২০-২১ পর্যন্ত, নিউ এপলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, জনসেবা প্রাইভেট ক্লিনিক ২০২১-২২ পর্যন্ত, আকবর ক্লিনিক ২০১৮-১৯ পর্যন্ত, আকবর ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৮-১৯ পর্যন্ত, চৌধুরী নুরুন নাহার জেনারেল হাসপাতাল ২০১৯-২০ পর্যন্ত, চৌধুরী নুরুন নাহার জেনারেল হাসপাতাল ২০১৯-২০ পর্যন্ত, কুষ্টিয়া ডায়াবেটিস সমিতি মজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস হাসপাতাল ২০২১-২২ পর্যন্ত, কুষ্টিয়া ডায়াবেটিস সমিতির ল্যাবরেটরী ২০২১-২২ পর্যন্ত, ভিশন চক্ষু হাসপাতাল ২০২১-২২ পর্যন্ত, কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ২০২১-২২ পর্যন্ত, কেয়ার স্পেশালাইজড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, বিসমিল্লাহ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, বিসমিল্লাহ ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, আগা ইউসুফ আধুনিক হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২০-২১ পর্যন্ত, নিউ শাওন প্রাইভেট ক্লিনিক ২০২১-২২ পর্যন্ত, ডক্টরস ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৯-২০ পর্যন্ত, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৮-১৯ পর্যন্ত, গ্রীনল্যাব মেডিকেল সার্ভিস ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ইসলামিয়া হাসপাতাল ২০১৯-২০ পর্যন্ত, ঝাউদিয়া ক্লিনিক ২০১৯-২০ পর্যন্ত, হাদী হানিফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল ২০২১-২২ পর্যন্ত, বৈশাখী ক্লিনিক ২০২১-২২ পর্যন্ত, সিটি স্পেশালাইজড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২১-২২ পর্যন্ত, সিটি স্পেশালাইজড হসপিটল ২০২১-২২ পর্যন্ত, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০১৮-১৯ পর্যন্ত, দি মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২০-২১ পর্যন্ত, নিউ মর্ডান প্রাইভেট হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২০-২১ পর্যন্ত, নিউ মর্ডান প্রাইভেট হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০২০-২১ পর্যন্ত তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছেন।
এদিকে লাইসেন্স নবায়ন না করে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাতে না পারার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘদিন লাইসেন্স নবায়ন না করেই চলেছে কুষ্টিয়ার অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর এই সব ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত ভূল চিকিৎসায় অকালে প্রাণ যাচ্ছে সেবা নিতে আসা রোগীদের। যদিও সবশেষ ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ দাউদ আদনান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- “দেশের যেকোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় নিবন্ধনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবা প্রদানের দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ওপর বর্তাবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই আদেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন কুষ্টিয়ার ডাক্তাররা।